
আঁখি চক্রবর্তীঃ বারাণসী জংশনের বাইরে থেকে ই-রিক্সা, অটো দুইই পাওয়া যায়, তবে একটু দামাদামি করে নেওয়াই ভালো। যাইহোক, বারানসী বললেই যে গোদৌলিয়া চকের কথা মনে আসে আমাদের গন্তব্য কিন্তু সেখানে ছিল না। আমাদের গেস্ট হাউস পৌঁছোনোর জন্য আমাদেরকে নামতে হল মইদাগিন, কোতোয়ালি থানার সামনে। সেখান থেকে গেস্ট হাউসের এক দাদাই নিয়ে গেলেন আমাদেরকে। পৌঁছে স্নান করে খেয়েদেয়ে জিরিয়ে নিলাম সবাই একটু। কলকাতায় থাকতেই মনখারাপের খবর শুনেছিলাম একটা, গঙ্গা আরতি নাকি বন্ধ কুম্ভের ভিড়ের জন্য! মনে তেমন একটা আশঙ্কা নিয়েই বেরোলাম ঘাট দর্শনে। আগেই বলেছি, আমাদের থাকার জায়গার সবথেকে কাছে ছিল মণিকর্ণিকা ঘাট। তার উদ্দেশ্যেই চলা শুরু করলাম।
প্রথম পর্বঃ https://sonarpurupdate.com/varanasi-travel-experience/
বেনারসের গলির মধ্যে কেমন যেন একটা ব্যাপার আছে, শুধু গলি নিয়েই একটা গোটা বই লিখে ফেলা যেতে পারে! ষাঁড়, গরু, মানুষ, সাইকেল, বাইক, স্কুটি মিলে একটা জগাখিচুড়ি মার্কা ব্যাপার। কিন্তু সে ব্যাপারটাও বেশ উপভোগ্য।এখানকার গলিতে গলিতে নানা দেবতার মন্দির। গলির রাস্তা গুলিয়ে যাওয়াটাও বড্ডো স্বাভাবিক,তবে তখন গুগল ম্যাপকে ভরসা না করে আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করাই শ্রেয়, সব্বাই সর্বদা প্রস্তুত এখানে সাহায্য করার জন্য। এসব নিয়ে চলতে চলতেই সেই ঘাটে এসে পৌঁছোলাম যার জন্য বারাণসীতে মৃত্যুও উৎসব! মণিকর্ণিকা। কথিত আছে মহাদেব এ নগরী প্রতিষ্ঠার সময় মা অন্নপূর্ণাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করান যে যতদিন বারাণসী থাকবে ততদিন সবার ‘ভুক্তি’ অর্থাৎ ক্ষুধা নিবারণের দায়িত্ব মায়ের, আর স্বয়ং মহাদেবের দায়িত্ব ‘মুক্তি’ প্রদান করার। মণিকর্ণিকার শ্মশানে মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে। সেই ৯ ডিগ্রি হেলে থাকা অদ্ভুত রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির দেখে, বিশ্বনাথ মন্দির করিডর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। নেপালী টেম্পল, ললিত ঘাট, মানমন্দির ঘাট পেরিয়ে পৌঁছোলাম সেই বিখ্যাত দশাশ্বমেধ ঘাটে। মনের এতক্ষণের দ্বিধা কেটে গেল।দেখলাম আরতির জায়গা সাজানো হচ্ছে মহাসমারোহে। বসে পড়লাম এক জায়গায়। কিছু পরে গঙ্গা আরতি শুরু হল। তারপরের যে অনুভূতি তা শুধু অনুভবই করা যায় হয়তো, শব্দে লিখলে তার কিছুই ধরা পড়বে না। শুধু এটুকু বলতে পারি ওই কিছুসময়ের জন্য দেবতারা হয়তো স্বয়ং নেমে আসেন মানুষকে পার্থিব সমস্তকিছুর থেকে দূরে নিয়ে যেতে। আরতির শেষে মুগ্ধতার রেশ ছিঁড়তে সময় লেগেছিল কিছু, কিন্তু তা একবার হতেই পেট জানান দিল, এবার পেটপুজোর টাইম। দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে উঠে রাস্তায় এলেই প্রচুর দোকান আশেপাশে। তার একটা থেকেই খাওয়াদাওয়া করে গেস্ট হাউসে ফিরলাম তাড়াতাড়ি।ওই দিনের সবথেকে সুন্দর উপলব্ধিটা যে তারপরই পাওয়ার কথা ছিল।গেস্ট হাউসের চিকু ভাইয়ার সাথে বাবা বিশ্বনাথের শয়ন আরতি দেখতে যাবার কথা হয়েছিল আগেই। রাত দশটা নাগাদ আমরা সব্বাই রওনা দিলাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে। ভাইয়া যেতে যেতে বলছিলেন এ অভিজ্ঞতা আজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। তখন শুধু কথাগুলো কথাই মনে হয়েছিল,কিন্তু ম্যাজিকটা ঘটল এরপর।
মন্দিরের চার নম্বর গেট আমাদের থাকার জায়গা থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। আমরা যখন পৌঁছোলাম তখন মানুষের ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে। এই প্রথমবারের জন্য তাঁর দরবারে পা রাখলাম।বুকে কী যে অদ্ভুত একটা আনন্দের ঢেউ উথাল-পাথাল করছিল! মন্দিরের চারপাশে এতকিছু নতুন নির্মাণ হলেও, মূল মন্দির কিন্তু তার সেই সনাতন রূপে স্বমহিমায় বিরাজ করছে। সোনার পদ্মের মতো রূপ তার।সোনায় বাঁধানো শিখরগুলি স্বর্গীয় জ্যোতিতে উজ্জ্বল। মূল মন্দিরের চারটি দরজার একটির সামনে এসে পৌঁছোলাম একসময়। তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিশ্বেশ্বর তখন তাঁর রাজাধিরাজ সাজে। চোখ ঝলসে যায় সে রূপ দেখলে। মন্দির প্রাঙ্গনে দাঁড়ালাম এরপর। ভাইয়া বললেন, এ আরতি বন্ধ দরজার মধ্যে হয়, এ আরতি দেখার নয়, অনুভব করার। তখন কথাটা বুঝিনি, বুঝলাম একটু পরে। কোথা থেকে যেন জনে জনে মানুষ এসে জড়ো হল, এরা প্রত্যেকে বাবার কাছে এসেছেন, তাঁদের আত্মার আত্মীয়কে গান গেয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্য। শুরু হল শয়ন আরতি, শুরু হল সমবেত গলায় কী অপূর্ব ঘোর লাগা এক গান। এমন ভক্তিধারার অবারিত প্রবাহতে কেউ কাউকে আটকে রাখতে পারে না, ভেসে যেতে হয় শুধু, ডুবে যেতে হয়। ১০:৩০ থেকে ১১:১০, সেদিনের এই রাতের সময়টুকুর জন্য মনুষ্যজন্মকে সার্থক বলতে একটুও দ্বিধা নেই কোথাও। নিজের খেয়ালে কখন হেসেছি, কেঁদেছি নিজেই বুঝিনি। আরতি শেষে প্রসাদে পরমান্ন পাওয়া এ পরমপ্রাপ্তিকে আরো পূর্ণ করে তোলে। সে রাতের সে সময়টুকুর রেশ কাটেনি, কাটবেনা কখনও, যতদিন এ জীবন আছে সে রাতটুকুও থাকবে।