শর্মিষ্ঠা মন্ডলঃ শিবভক্তদের কাছে পশুপতিনাথ এক পরমতীর্থ, আর আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মহাদেবের প্রতি যে টান, তা যেন আরও গভীর হয়ে উঠল যখন সুযোগ এল পড়শি দেশ নেপালে অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দির দর্শনের।
আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ৯ই মে ২০২৫, হাওড়া থেকে রওনা দিয়েছিলাম রক্সৌল এক্সপ্রেসে। পরদিন সকাল ৯টা ৩০ নাগাদ পৌঁছাই রক্সৌলে, সেখান থেকে টাঙ্গা করে পৌঁছে যাই বিরগঞ্জ। কাগজপত্রের যাবতীয় কাজ সেরে বিকেলে পৌঁছাই পোখরা। সেখানে হোটেল ব্লু ম্যাগনেটে ছিল তিনদিনের প্রোগ্রাম। এরপর ১৪ই মে সকালে মনোকামনা মন্দির দর্শন সেরে আমরা রওনা হই কাঠমান্ডুর পথে, গন্তব্য — পরমতীর্থ পশুপতিনাথ। ১৫ই মে সকালে প্রস্তুতি সেরে পৌঁছে যাই মন্দির প্রাঙ্গণে। প্রবেশের আগে জুতো, মোবাইল রেখে দিতে হয় নির্দিষ্ট দোকানে। যেখান থেকে ডালা নেওয়া হয়, সেখানেই এই জিনিসপত্র রাখতে হয়, কারণ মন্দির কর্তৃপক্ষ যেখানে-সেখানে জুতো খুলে রাখলে তা সরাসরি ফেলে দেয়। মন্দিরে কোনো প্রবেশমূল্য নেই, এবং লক্ষ করলাম, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু ভক্ত এসেছেন বাসভর্তি হয়ে। পবিত্র বাগমতী নদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দিরে রয়েছে প্রায় ৫১৯টি উপমন্দির। মূল মন্দিরটি নেপালি প্যাগোডা স্থাপত্যে নির্মিত, যার ছাদ সোনায় মোড়া তামার তৈরি। চারটি রুপার দরজা রয়েছে, দুটি গর্ভগৃহসহ পুরো মন্দির চত্বর খোলা থাকে সকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। ইতিহাস বলছে, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের আশেপাশে এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
মন্দির চত্বরে কয়েকজন পুরোহিত ‘স্পেশাল দর্শন’ ও ‘অভিষেক’-এর কথা বলছিলেন। মনে হয়েছিল এও কি আরেকটা ব্যবসা? তবুও লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম, গাড়ির ড্রাইভার সময় বেঁধে দিয়েছিল। লাইনে দাঁড়িয়ে যখন একেবারে বিশেষ প্রবেশদ্বারের পাশে এসেছি, হঠাৎ মনে হল গার্ডকে অনুরোধ করি। আমার সঙ্গে বলাকা দি ও জয়ন্তী দি ছিলেন। আমরা তিনজনে কাকুতি-মিনতি করায় গার্ড একসময় রাজি হয়ে যান। আমাদের ঢুকতে দেয়, সঙ্গে সঙ্গেই দরজা বন্ধ করে দেন। আর তখনই সেই পরম মুহূর্ত — সামনে দেবাদিদেব মহাদেব! প্রায় চারশো বছরের প্রাচীন এই মন্দিরে ধূপ, ধুনো, মন্ত্রোচ্চারণ, ভক্তদের ভিড়ের মধ্যেও এক অপার্থিব অভিষেক দর্শনের সৌভাগ্য ঘটে। চোখে জল এসে গিয়েছিল, হাতজোড় করে বলেছিলাম, “তুমি করুণা করেছ বলেই দর্শন হল।” সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এক অপার শিহরণ যেন শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বাস যেন আরও দৃঢ় হয় — তিনি আছেন, ছিলেন এবং থাকবেন চিরকাল। মন্দিরের পরিবেশ, পূজার পদ্ধতি, ভক্তির আবহ — সবই মন ছুঁয়ে যায়। যদিও মুক্তিনাথের মতো এখানে ইচ্ছেমতো পুজো দেওয়া যায় না, তবে ডালার ফুল দিয়ে অন্তত বাবার চরণ ছোঁয়া গিয়েছিল। সেই ফুল আমি চেয়ে নিয়েছিলাম পূজারির কাছ থেকে।মন্দিরে প্রবেশ করলেই ভক্তি জেগে ওঠে, আর বিগ্রহ দর্শনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বাগমতীর তীরে দাঁড়িয়ে মনে হল, সত্যিই, “পরমেশ্বরের পদদেশেই রয়েছে মায়ার জগৎ থেকে মুক্তি।” পশুপতিনাথ যাত্রা যেন পূর্ণতা পেল এই অপার অভিজ্ঞতায়।
