
শর্মিষ্ঠা মন্ডলঃ আমি শর্মিষ্ঠা মন্ডল। পেশায় শিক্ষিকা এবং বসবাস সোনারপুরে। সুযোগ পেলেই আমি বেরিয়ে পড়ি—কখনও পরিবার, কখনও ভ্রমণপিয়াসী বন্ধুবান্ধবদের সাথে, আবার কখনও একা। এবারে আমার গন্তব্য ছিল এক বিশেষ তীর্থস্থান—নেপালের মুক্তিনাথ। প্রাথমিকভাবে আমি ও আমার এক বান্ধবী এই যাত্রার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর কিছু সমস্যার জন্য তিনি যেতে না পারায়, আমি একাই এক অজানা দলের সঙ্গে রওনা দিই। একটি ট্রাভেল এজেন্সি আমাদের এই যাত্রার ব্যবস্থা করে দেয় ৷
যাত্রার শুরুতে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও ধীরে ধীরে সেই অচেনা দলটি আপন হয়ে উঠলো। যোগাযোগের সেতুবন্ধন গড়ে উঠল এক অপূর্ব বন্ধন হিসেবে, আর মুক্তিনাথ দর্শনের মাধ্যমে আমি উপহার পেলাম এক অনন্য, আধ্যাত্মিক এবং মননের মুক্তির অভিজ্ঞতা।
যাত্রার সূচি (Itinerary summary)
- ৯ মে: হাওড়া থেকে মিথিলা এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু বিকেল ৩:৫০-এ।
- ১০ মে: সকাল ৯:১৫-এ রক্সৌল পৌঁছে তাঙ্গা চড়ে সীমান্ত পার হয়ে নেপালের বীরগঞ্জে প্রশাসনিক কাজ সেরে, দুপুরের পর বাসে পোখরার পথে যাত্রা। রাতে পৌঁছই ‘Hotel Blue Magnet’।
- ১১ মে: পোখরার স্থানীয় দর্শন।
- ১২ মে: বাসে যাত্রা শুরু জমসমের পথে (৮৯২১ ফুট), হোটেলে রাত্রিযাপন।
- ১৩ মে: জমসম থেকে গাড়িতে মুকিনাথ (১২৩৪৩ ফুট) যাত্রা। পূজা ও দর্শনের পর ফের পোখরায় ফেরা।
- ১৪ মে: মনোকামনা মন্দির দর্শন ও রোপওয়ে রাইড সহ কাঠমান্ডুর পথে যাত্রা।
- ১৫ মে: পবিত্র পশুপতিনাথ মন্দির দর্শন ও পূজা।
- ১৬–১৭ মে: স্বয়ম্ভূনাথ, বোদ্ধনাথ স্তূপ, ভক্তপুর, দুরবার স্কয়ার প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থান ঘোরা।
- ১৮ মে: কাঠমান্ডুতে কেনাকাটা।
- ১৯ মে: কাঠমান্ডু থেকে রাতের বাসে বীরগঞ্জে ফেরা।
- ২০ মে: রক্সৌল থেকে মিথিলা এক্সপ্রেসে হাওড়ার পথে রওনা।
- ২১ মে: ভোর ৪টায় হাওড়া পৌঁছে ঘরে ফেরা, সঙ্গে হৃদয়ে অপূর্ব সব স্মৃতি।
মুক্তিনাথ: এক আত্মিক অভিজ্ঞতা
মুক্তিনাথ হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। কল্পনাতীত সৌন্দর্যের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাঠ-পাথরের কারুকার্যখচিত মন্দির। শান্ত নিসর্গ, পিপুল গাছের ছায়া, আর জাপানি প্যাগোডা ধাঁচের মন্দিরে প্রবেশের মুখে লেখা—“Welcome to Muktinath”। ভিতরে অধিষ্ঠান করছেন শ্রীবিষ্ণু, দুই পাশে মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী। পাথরের চত্বর ঘিরে শতাধিক পিতলের জীবজন্তুর মুখ থেকে ঝরছে পুন্যজল। এক অপরূপ পরিবেশে নিজ ইচ্ছায় পূজা দেওয়া যায়—আছে না কোনও পাণ্ডার অনুশাসন। শান্তি ও মুক্তির অভিজ্ঞতায় হৃদয় জুড়ে যায়।
বিশেষ তথ্য ও নির্দেশিকা
- যাত্রার খরচ: হাওড়া থেকে হাওড়া (খাবার, থাকা, যাতায়াত সহ) — ৩AC: ₹১৮,৩০০ / SL: ₹১৭,৩০০।
- আবশ্যিকতা: যুব আবাসন সদস্যপদ, আধার কার্ড, ৩ কপি পাসপোর্ট ফটো।
- মুদ্রা বিনিময়: নেপালে ভারতীয় রুপি বদল করে নেপালি রুপি নিতে হয় (হার ₹১০০ = NPR ১৬০ আনুমানিক)।
- টিপস:
- ফোন ও ATM কাজ করে না, স্থানীয় সিম কিনতে হবে।
- ব্যাগ, উষ্ণ পোশাক, ঔষধপত্র, ছাতা ও নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী সঙ্গে রাখতে হবে।
- অনুগ্রহ করে দলীয় নিয়ম মেনে চলুন এবং সহযাত্রীদের সঙ্গে সমন্বয় রাখুন।
মুক্তিনাথ দর্শনে প্রকৃত অর্থে মুক্তি মেলে কিনা জানি না, তবে এই সফর আমার মনের গ্লানি, ক্লেদ, দুশ্চিন্তা অনেকটাই মুছে দিয়েছিল। একা রওনা দিয়েও ফিরে এলাম হৃদয়ে ভরে যাওয়া এক ঝলমলে অভিজ্ঞতা নিয়ে। এই সফর আমাকে আরও একবার মনে করিয়ে দিল—অজানাকে আলিঙ্গন করলে, জীবনের রং আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।